15 C
New York

অসাধারণ মেয়ের সাধারণ গল্পঃ : শিলচরের মহুয়া দাস

Published:

স্বজন হারায় ব্যথায় ব্যথিত দেশে দশে তিনি সম্মানিত সারদা মায়ের কাছে হয়ে সমর্পিত
আরো এক অসাধারন মেয়ে সমাদৃত

সপ্তমিতা:- আপনি নাকি নর্থ ইষ্টে এ স্বামী বিবেকানন্দ ও মা সারদাকে নিয়ে পরিচিতি লাভ করেছেন । জানতে পেরে আপনার কাছে ছুটে আসলাম যা কোন মহিলার পক্ষে প্রথম।

……..সে আমি বলব যেহেতু স্বামীজি ও মা সারদাকে নিয়ে কাজ তাই উনাদের কাজ ওনারাই করেছেন আমি তো নিমিত্ত মাত্র।

যুব দর্পণ এর পক্ষে সমাজকর্মী মহুয়া দাসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - সপ্তমিতা নাথ

সপ্তমিতা:-বা: , বেশ এ  তো সমর্পণের উক্তি তবে
কি নাম আপনার জানতে পারি।

……আমার নাম মহুয়া দাস

সপ্তমিতা:-কি করেন আপনি? মানে আপনার পেশাগত পরিচয়টা কি?

মহুয়া:- অনেক কাজই তো করি যা পেশা হতে পারতো কিন্তু আমি পছন্দ করেছি উন্নত থেকে উন্নত কাজ পরিবারকে দেওয়ার তাই কোন মাইনে ছাড়াই কাজ করি অন্য ভাষায় যাকে গৃহবধূ বলা হয়। মা সারদার ভাষায় এটাই উৎকৃষ্ট কাজ পরিবার গঠন।

সপ্তমিতা:- সঠিক বললেন গৃহবধূ মহিলাদের এইসব কাজের কোন মূল্যায়ন কখনো হয়নি। তবে ইতিবাচক দিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে পারি এটা আপনার শখ যেহেতু আপনি বলেছেন আপনি পছন্দ করে বেছে নিয়েছেন।

মহুয়া :-তা বলতে পারেন ।তবে শখ বা নেশার তালিকায় আরো কিছু আছে।
সপ্তমিতা:- হা হা বেশ তো জানতে পারি?
মহুয়া;- আমি পড়তে ভালোবাসি লিখতে ভালোবাসি, ঘর সাজাতে ভালোবাসি ও রান্না করতে খুব ভালোবাসি।

সপ্তমিতা:- বেশ ,কিন্তু একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দ যদি দেখি একটা কথা খুব প্রাসঙ্গিক যা না বলে পারছি না।এই নেশা অনেকেরই রয়েছে মানে আরও দশটা মেয়ের রয়েছে ।আপনি কিভাবে শখকে নিয়ে এগিয়ে গেছেন বা বলতে পারি কিভাবে আপনাকে এই সবগুলো ভিন্নতা দিয়েছে।

মহুয়া :-হ্যাঁ। প্রথম প্রথম আমার কাছেও এই সবগুলোকে খুব স্বাভাবিক মনে হতো ।তবে চরম পরিস্থিতিতে এসে এই শখগুলোই কোন না কোন ভাবে আমাকে বাঁচার পথ করে দিয়েছে।

সপ্তমিতা:- বাঁচার পথ মানে কি এমন হলো যে আপনি পথ হারালেন?
মহুয়া :-আমি যেহেতু গৃহবধূ ,আমার কাছে আমার পরিবারই সর্বস্ব ।তাই পরিবারের সকল সদস্যদের একে একে হারাই তখন এ জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার কাছে অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়ল।
সপ্তমিতা:- জীবনে ভালো থাকতে আমাদের সঙ্গী চাই ,সাহারা চাই, আপনজন চাই ।আপনি যেহেতু স্বামীজি ও শ্রীমার ভক্ত তাদের অনুসরণে যদি বলি তো আমাদের মধ্যে যে প্রাণ স্বরূপ প্রাণপ্রিয় ঈশ্বর বিরাজমান তার প্রতি তো আমাদের কর্তব্য রয়েছে? তাই কিনা?
মহুয়া:- তাইতো বললাম যখন আমি একাকিত্বের অন্দরমহলে ডুব দিলাম তখন বই পড়াকে অন্ধকারের আলোর পথিক করে নিলাম। আরো বেশি বেশি করে জানলাম স্বামী বিবেকানন্দকে জানলাম মা সারদা কে ।পৃথিবীর ভেতরে জীবনের অনেক অনেক অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে পেলাম।

সপ্তমিতা:- যে অর্থ বা আলোর উৎস নিয়ে আপনি উঠে দাঁড়ালেন সেই আলোর বিকিরণ সমাজের তরে বিলিয়ে দেওয়ার কোন চেষ্টা করেছেন কখনো? বা বলতে পারি সমাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন কখনো ?আপনার এই অনুভূতি নিয়ে। না এ শুধু আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা ।
মহুয়া;- আমার স্বামী একজন আসাম সরকারের বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলেন ।উনি ও উনার বন্ধুরা মিলে ইন্ডিয়ান ট্রেনিং একাডেমি বলে একটি সেন্টার চালাতেন। যা মূলত খুলেছিলেন স্বপন পাল ,সেখানে বিভিন্ন স্কুল থেকে আগত ছাত্রদের বিনামূল্যে বিভিন্ন ট্রেনিং দেওয়া হতো যেমন প্রাইভেট কোচিং ,গান, কবিতা ,যোগা ইত্যাদি। তাছাড়াও প্রপ্তবয়ষ্কদের জন্য ছিল ইণ্সূরেন্স এর ট্রেনিং ও সুখী পরিবার গঠনের বিভিন্ন কলা কৌশল ও সজাগতা মূলক ট্রেনিং।
রামকৃষ্ণ মিশনে ছাত্রদের জন্য একটি ভ্যালু ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম রাখা হয় সেখানে অনেক স্কুল থেকে দশম ও একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা যোগদান করতো , যার বিষয়বস্তু ছিল ছাত্রদের শারীরিক গঠন ও যুব কল্যাণ , যা নির্ধারিত হতো সম্পুর্ন ভাবে রামকৃষ্ণ মিশন কত্তৃক। বিষয়গুলোর মূল আলোকপাতের কেন্দ্র ছিল স্বামীজির জীবণ আদর্শ। সেখানে ও আমাদের একাডেমির ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত যোগদান করতো।

১২ জানুয়ারি স্বামীজির জন্মদিনের ঠিক পরে পরে দু দিন ব্যাপী ভ্যালু অরিয়েণ্টশন প্রোগ্রাম হয় , সমাজ গঠনের উপর। যেখানে মহারাজ ও বিদগ্ধ জ্ঞানী গুণীরা উপস্থিত থাকেন।সেখানে শহর শিলচরের সব স্কুল ও ইষ্টিটিউট এর ছাত্রদের আমন্ত্রণ জানানো হয় যোগদান করার জন্য। তখন ও আমাদের একাডেমির ছাত্রছাত্রীরা যোগদান করতো সবসময় এবং এর জন্য আমি স্ক্রিপ্ট  লিখে তাদের শিক্ষক হয়ে উপস্থিত থাকতাম মিশনে এবং বলা বাহুল্য অনেক প্রশংসা কুরিয়েছে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা, এটা আমার লেখালেখি ও পড়াশোনার ই ফসল। এবং এই যঞ্জ এখনো ও অব্যাহত।

সপ্তমিতা:- আপনি বললেন শখের তালিকায় আরো একটা রয়েছে । তা সে শখ আপনাকে কিভাবে পরিপূর্ণতা দিল ?

মহুয়া:- আপনি হয়তো রান্নার কথা বলছেন ।তা নিয়েও রয়েছে গল্প যখন আমার কখনো খুব রাগ হতো বা কখনো স্বামীর সাথে ছোট খাটো মনোমালিন্য হতো আমি রান্না কে বেঁছে নিতাম তখন ভারাক্রান্ত মন কে শান্ত করার জন্য। আর ও বেশি যত্ন করে রকমারি রান্না করতাম , এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন যেন আরও সুস্বাদু হতো খাবার । ।

সপ্তমিতা:- এ ‘যে আবেগের রূপান্তর সৃষ্টি ।’ রান্না বাঙালিয়ানার এক বৈশিষ্ট্য । ঘটি, ঢাকাইয়া , শ্রেণীবিন্যাসে রয়েছে রান্নার বিভিন্নতা । আপনি কোথা থেকে? বা আপনার জন্ম বেড়ে ওঠা কোথায়?

মহুয়া :-আমার জন্ম অসমের ডিব্রুগড় শহরে ।১৯৮১ সালে যখন আসামে অসমীয়াদের  বাঙালি নিয়ে অগ্রাসন চলছিল তখন বাধ্য হয়ে বাবা, দিদি(মৌসুমী দে) মা (সন্ধ্যা দে )ও আমাকে কলকাতায় রেখে আসেন যাতে আমাদের পড়াশুনার কোন ব্যাঘাত না হয় । আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি ।বাবা চাকরী সূত্রে এখানেই থাকলেন ।

সপ্তমিতা :-আপনার বাবার নাম কি । কি বিভাগে কাজ করতেন তিনি?
মহুয়া :বাবা সুরেন্দ্রচন্দ্র দে। তিনি একজন রেলওয়ে অফিসার ছিলেন।

সপ্ত:- রান্না যখন আপনার শখ তখন আজকাল রান্না নিয়ে অনেক অনেক স্বনির্ভরশীলতা গড়ে উঠছে বা অন্যদেরকেও কর্মসংস্থান করে দিচ্ছেন অনেকে ।তা আপনি কেন সেদিকে গেলেন না ।

মহুয়া:- খুব ইচ্ছে ছিল  একটা ষ্টার্ট আপ খুলবো।মহুয়াস কিচেন নামে এক রান্নাঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়, আমাদের বাড়ির ছাদে  ।পরিকল্পনা, পড়ে আস্তে আস্তে তাকে স্থানান্তরিত করে বৃহত্তর কিছু করার কিন্তু লোক ও অন্যান্য কোন কারণে হয়ে উঠে নাই তারপর স্বামী ও চলে গেলেন রামকৃষ্ণ লোকে।

সপ্তমিতা:- খুবই দুঃখিত শুনে ।যদি কিছু মনে করেন না যদি তবে কি বিবাহিত জীবনের অল্প বিস্তর জানতে পারি?
মহুয়া :- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার ঠিক পড়ে পড়ে বিয়ে হয়ে যায় ।ইচ্ছে ছিল বাণিজ্য বিভাগে পড়াশোনা করে, আরেকটু এগোবো কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।স্বামী খুব পরোপকারী ও সমাজ সেবামূলক কাজ করতে ভালোবাসতেন ।আমরা দুজনেই রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত ।সেই সূবাদে মিশনে যেতাম দুজনেই। ২০১০ সালে রামকৃষ্ণ মুক্ত মঞ্চের আহ্বানে প্রথম রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ ও মায়ের কথা বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু হয় আমার যাত্রা। তারপর বিভিন্ন স্থানে গীতা ও ভাগবত পাঠ করা চলছিল সমসাময়িক ভাবে।

সপ্তমিতা:- তা আপনি যে স্বামীজি ও মা সারদা কে বেছে নিলেন বা তাদেরকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন তার পেছনে কি যুক্তি রয়েছে?

মহুয়া :-নিশ্চয় যুক্তি আছে ।প্রথমে বলব স্বামী বিবেকানন্দ কে না জানলে ভারতের ঐতিহ্যকে একসাথে জানা হয়তো সম্ভব হবে না। মা সারদার কথা যদি বলি ,উনি মূলত জীবন
শিক্ষা দিয়ে গেছেন তার আচরণে, । সত্য নিষ্ঠার উপর আস্থা রেখে সুখী জীবনযাপনের কৌশল জানতে হলে জানতে হবে মা সারদা কে।

সপ্তমিতা:- স্বামীজি তো নারী জাতির উন্নয়নে অনেক কাজ করে গেছেন। যেহেতু আপনি উনার আদর্শিত পথে চলছেন ,সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আছে কি আপনার।

মহুয়া :-প্রতি রবিবারে মিশনে ভ্যেলু অরিয়েণ্টিশন  অনুষ্ঠান হয় যেখানে মেয়েরা মিশনে যেতে পারে না। কারণ কিছু নিয়মের জন্য।স্বামীজী প্রথম থেকে ই চেয়েছিলেন মেয়েদের উন্নতিকল্পে ও শিক্ষকল্পে ‘সারদা মঠ ‘ ও পড়ে হবে রামকৃষ্ণ মঠ । কিন্তু বাস্তবিক এ তার হয়ে উঠে নাই । বরং প্রথমে গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও বহু পরে সারদা মঠ , তখনকার সমাজ ব্যবস্থার জন্য। এই সারদা-মঠ নর্থইস্ট এ শুধু অরুণাচল প্রদেশে আছে ।আসামে কোন শাখা নেই তাই আমরা কয়েকজন ভক্তরা মিলে সংকল্প নেই যে আমরা শিলচরের সারাদা মাঠের একটি শাখার ভিত্তি স্থাপন করব ও সঙ্গে ছিলাম আমি ও আমার স্বামী । এটাই শুরু , তখন এন আই টি সংলগ্ন বরাক হাই হাইস্কুলের পাশে ১৪ কাটার একটা প্লট কেনা হলো ।

সপ্তমিতা:- আপনাদের এই শুভচিন্তাকে সাধুবাদ জানাই ।তা কি রকম কাজকর্ম চলছে সারদা মাঠে?

মহুয়া : সারদা মঠের বিশ্বজুড়ে ৩৪ টা শাখা নিয়ে হেড অফিস গড়ে উঠেছে দক্ষিণেশ্বর কলকাতায়। ২০১৩/১৫ তে তৎকালীন মঠের সেখানকার সেক্রেটারি প্রব্রাজিকা অমল প্রাণা মাতাজীর অনুমতি নিতে একটা ট্রাষ্ট গঠন করে কিছু কাজ শুরু হয় , এবং মাতাজী নামাকরন করলেন শ্রী মা সমিতি । তিনি বলেছিলেন কিছু সেবা ও গঠনমূলক কাজ করে দেখাতে হবে ‘সারদা মঠ’ করতে হলে । তখন থেকেই অনেক ছোট বড় সেবামূলক কাজ চলছে বিভিন্ন প্রজেক্টে যেমন মেডিকেল ক্যম্প, বস্ত্রদান, রক্তদান তাছাড়াও বিভিন্ন সময় ভিত্তিক সহযোগির হাত বাড়ায় ট্রাষ্ট, সময়কাল করোনা কাল ও বন্যা ইত্যাদি।

সপ্তমিতা:-একটা প্রশ্ন মনে মনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে মানবতার পূজারী হয়ে স্বামীজি কেন মহিলা পুরুষদের জন্য আলাদা চিন্তা করলেন ।কেনই বা এই বৈষম্য?

মহুয়া :-স্বামীজি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের স্ত্রী পুরুষের কোন আলাদা ব্যবস্থা না থাকায় যে চরম পরিণতি হয়েছিল সেই কথা বিবেচনা করে  মহিলাদের  উন্নতিকল্পে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।তিনি তাই উল্লেখ করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন যেন “নেড়ানেড়ির আখড়া” না হয় । তৎকালীন সমাজ ব্যবসায় তাই বাস্তবায়িত হয় নি , যা পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছে নিছক শুদ্ধতায় ” সারদা মঠ” নামে।

সপ্তমিতা:- মূলত কি ধরনের কাজ হয় সারদা মঠে।

মহুয়া:- মহিলা স্বশত্তীকরণের সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়  । বিভিন্ন অঞ্চল, গ্রামাঞ্চল, সাধারণ ও  দুস্তঃ শিশু মহিলা উভয়ের জন্য রয়েছে স্বাস্থ ও শিক্ষা। নিবেদিতা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি রয়েছে সারদা মাঠের আওতায় ।তাছাড়া গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা সবথেকে বড় বিষয় হলো মাতাজীদের সংস্পর্শে থেকে  নৈতিকতার সাথে  মানুষ হওয়ার সুযোগ।

সপ্তমিতা:- আজকাল সচেতন অভিভাবক মহলে প্রতিটি শিশু কোন না কোন স্কুলে ভর্তি হয় তবে কেন মনে হয় তাদের সারদা মঠের স্কুলে ভর্তি হওয়া দরকার বা বলতে পারি যে কি  সুবিধা রয়েছে যা সারদা মঠ দিতে পারবেন অন্য স্কুল দিতে পারবেনা?

মহুয়া :-নৈতিকতা ও ধর্মীয় সংস্কার।
আজকাল শিশুরা জন্মানোর পর থেকেই অনেক বেশি আইকিউ নিয়ে জন্মায় যা বৈজ্ঞানিকরা স্বীকার করেছেন ।এই বারতি মেধার জন্য ওরা  সব সময় চঞ্চল প্রকৃতি হয় ,আবার কয়েক বছরের পর দেখা যায় তারা চুপ করে যায়। অর্থাৎ কোথাও ফাস্ত্রেটেড। অথচ আগেকার সাতটা আটটা সন্তান এতটুকু অ্যাটেনশন বা আদর পেত না যা এখনকার এক দুই সন্তান পায় তবে কেন এই অবসাদ এবং সেখান থেকেই প্রয়োজন রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা বৈদিক সংস্কারে জীবন শিক্ষা দিয়ে নৈতিকতার মধ্যে জীবন কে উন্নীত করে।

সপ্তমিতা:- মনে পড়লো আপনি উল্লেখ করেছেন যে সকল স্বজনদের হারিয়েছেন তা কি কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল?

মহুয়া:- না সে সব প্রাকৃতিক।  একদিন রাত্রিবেলা হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তা শুনে পরদিন সকালেই বাবা ও উনার সঙ্গী হলেন ও দুজনে একসাথে পাড়ি দিলেন রামকৃষ্ণ লোকে । সব থেকে বড় ধাক্কা টা ছিল, ঠিক সে সময় বাবা ছিলেন আমার কোলে শুয়ে , যে স্মৃতি আজও কোথাও তাজা। গতবছর একমাত্র দিদি যে অসুস্থ ছিল ,সেও চলে যায় আমাকে ফেলে ।
তারপর ২০১৯  সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আমার স্বামী।করোনার জন্য রোগ ধরা পড়ে নাই , তারপর যখন ধরা পড়লো চিকিৎসা করেছি কলকাতা টাটাতে , কিন্তু নিয়তির হাতে হার মানলাম , পারি নি শেষ রক্ষা করতে। যেদিন প্রথম ধরা পড়েছিল সেদিন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার কাল।

সপ্তমিতা:- আপনি পড়া কে আঁকড়ে ধরে জীবনে বাঁচার সন্ধান পেয়েছেন তবে সেদিন কেন এই পড়াকে কাল মনে হয়েছিল?

মহুয়া:-আমি পড়তে ভালোবাসি এমনকি একটা ছেঁড়া কাগজও আমি না পড়ে ফেলি না তেমনি ওষুধের প্যাকেট  এ থাকা মলিকুল সবকিছু আমি পড়তাম । সেদিন সেই রিপোর্ট দেখে  আমার পড়ার সুবাদে আমি সব বুঝে যেতে পারলাম আমার স্বামীর জীবন আয়ু নির্বাপিত হতে চলেছে ও হটাৎ করে যে কালো অন্ধকার নেমে আসছে আমার জীবনে তার আর বুঝতে বাকি থাকলো না। ২০২১ সালের ১৭ ই মার্চ একটানা পাঁচমাস চিকিৎসার পর রামকৃষ্ণ চরণে বীলিন হয়ে যান ও আমি হয়ে তাই সম্পুর্ন হাতছাড়া, একহাতে গুছিয়ে নিয়েছি নিজের খানিক জায়গা নিজের মতো করে ও সাথে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক জানালা।

সপ্তমিতা:- আপনার এই অপরনীয় ক্ষতিকে পূরণ করার কোন ভাষা নেই তবুও বলছি, পরিবেশটা বেশ আবেগিক হয়ে পড়েছে ।তবে যে মহিলা অনেকেরই সাহারা আবার তার কি সাহারার প্রয়োজন ?যাইহোক অন্য কথা বলি তবে যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ আমরা এসেছি সেদিকে কিভাবে এগোলেন।

মহুয়া :-সব স্বজন হারিয়ে বই কে সাহারা করলাম আরো জানতে শুরু করলাম স্বামীজিও সারদামাকে নিয়মিত রামকৃষ্ণ মুক্ত মঞ্চে থেকে আমার আরাধ্যদের নিয়ে পাঠ,বক্তৃতা ও সঞ্চালনা চলছিল অবিরাম।২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে  দক্ষিণেশ্বর সারদা মঠ থেকে ফোন আসলো একজন পরিচিত মাতাজী । বললেন ফেব্রুয়ারি ২ তারিখ দক্ষিণেশ্বর মঠে  স্বামীজির তিথি পূজা উপলক্ষে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখতে হবে, প্রথমে আমি রাজি হইনি, কারণ দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্কলার ও মাতাজীরা সেখানে যোগদান করেন কিন্তু পরবর্তীতে মাতাজীর আশ্বাসে মাতাজির কথা ফেলতে না পেরে উনাদের নির্ধারিত টপিকে বক্তৃতা লাগলাম। বিষয় ছিল “স্বামীজীর স্বপ্নের স্ত্রী মঠ।”

সপ্তমিতা :-আপনার উপস্থাপনা কেমন ছিল ও তার পরে আসামের মানুষদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

মহুয়া: আমার সেদিন বিশ্বাস হয়নি বা‌ আমি ভাবতে পারিনা যে আমি বলতে পারবো ।যা  পেরেছি এ যেন মা সারদাতে সমর্পিত আমি ।মা এসে আমার জিব্বাতে কথা বলেন। মাতাজিদের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িনো ছিল আমার প্রাপ্তির কোঠায় সর্বচ্চ। যখন বক্তৃতা শেষ হয় তখন আমি উষ্ণ সংবর্ধনায় ভাসি। ফিরে আসার পর অনেক উষ্ণ সংবর্ধনা পেয়েছি বিভিন্ন সংস্থা থেকে।
সপ্তমিতা:- পড়তে ভালোবাসেন তা জানলাম কিন্তু এভাবে বক্তৃতা দিতে গেলে কিছু লেখার অভ্যাসও থাকতে হয় তাই কি না ।

মহুয়া:- মহুয়া খুব ছোটবেলা থেকেই স্কুলের নিউজ তৈরি করার কাজ আমার ছিল আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। তারপর কলকাতার গণশক্তি পত্রিকায় ( মাঝে মাঝে) লিখতাম বিয়ের পর এখানে এসে যুগশঙ্খ পত্রিকায় লিখতে শুরু করি। এখানে এসে ভাষা আন্দোলনের কথা জানতে পেরে সে বিষয়ে লিখেছি , মাতৃভাষা নিয়ে লিখেছি । তাছাড়াও লিখেছি বিভিন্ন পাক্ষিক ও সারদীয় পত্রিকায়।তাছাড়া বিভিন্ন সময় আমাকে তৈরি করতে হয় স্ক্রিপ্ট।তবে আজকাল সবকিছু চাপা পড়ে গেছে।

সপ্তমিতা:- কেন চেপে রেখেছেন তুলে
ধরো না কেন।

মহুয়া:- কাগজ-কলম -কালি তো সব না কখনো কখনো খুব একাকিত্বে ভোগি তখন কিছুই ভালো লাগেনা।
সপ্তমিতা:- সে একাকীত্ব কিভাবে কাটান ? নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে শিক্ষণীয়, একজন রামকৃষ্ণের সন্তান হিসেবে।

মহুয়া :-সেই স্বামীজীর মন্ত্রে জীব সেবা। বিবেকানন্দ সোসাইটি জয়েন করেছি সুপ্রদীপ দত্ত রায় দাদার অনুপ্রেরণায় ।সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাচ্চাদের নিয়ে তৈরি হওয়া কোচিং সেন্টারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিভিন্ন ভাবে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, ও চেষ্টা করি যৎ সামান্য আর্থিক সহায়তা র হাত এগিয়ে দিতে। ব্লাড ডোনেশন করতে ভালোবাসি অল ইন্ডিয়া ব্লাড ডোনেশন ফোরাম এই সূত্রে আমাকে সম্মাননা প্রদান করেছে।

 

সপ্তমিতা:-রামকৃষ্ণ মিশন, স্বামীজি ও সারদা মা   আপনার পাথের পাথেয়। তাই পূর্ববর্তী জীবনে কোন আভাস পেয়েছিলেন আপনি যে এই দিকে যাবেন?
মহুয়া :-মায়ের কাছে গানের হাতে কড়ি। ডিব্রুগড় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথমবার গান করে সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছিলাম স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর হাত থেকে যিনি হচ্ছেন সারদা মায়ের শেষ মন্ত্র শিষ্য।
তারপর আমার নাকে একটা অপারেশন হয় আর আমি গান করতে পারি না ।

সপ্তমিতা:- মা সারদা স্বামীজি আপনার জীবন আদর্শ কিন্তু এই দুজন ঈশ্বরস্বরূপ ছাড়া  সমাজ জীবনে কোন ব্যক্তিত্বকে আদর্শ হিসেবে দেখেন কি।

মহুয়া:- অনেক কারণে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ভাবে আমি ডাক্তার লক্ষণ দাস ও রবিকান্নান এর সাথে পরিচিত হয়ে তাদেরকে ব্যক্তিগত ভাবে জানার সুযোগ পাই। তাছাড়া অনেক জায়গা থেকে বক্তৃতা রাখতে ডাকা হয়। যখন একবার নাগরিক স্বার্থরক্ষা কমিটি থেকে লক্ষণ দাসের বিষয়ে বলার সুযোগ পাই। তখন আমি উনার শিলচর বাসির জন্য ত্যাগ তুলে ধরলাম।তিনি সেই সময় অত্যন্ত খুশি হয়ে নিজে থেকে  আমার সাথে পরিচয় করান। পরবর্তীতে আমি স্বামীর সাথে কল্যাণী হাসপাতালে যাই সেখানে গিয়ে বিশদ জানতে পারি উনার জীবন যাত্রা ও ত্যাগ। ডাক্তার রবি কান্নান ও উনার পরিবারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠির সুযোগ পেয়েছি ও অনেক কিছু শেখার, বিষশ করে কান্নান স্যারের মায়ের কাছে থেকে।

সপ্তমিতা:- বলা বাহুল্য উনারা দুজনই আমাদের শহর শিলচরের সৌভাগ্য । তা আপনার আগামী দিনের পরিকল্পনা কি।
মহুয়া:+ ইচ্ছে তো অনেক আছে কিন্তু আমার সব ইচ্ছে স্বামীজি ও সারাদা মায়ের হাত ধরে স্বীকৃতি পায়। তবে শ্রীমা সমিতিকে সারদা মাঠে রূপান্তরে তার একজন শুদ্ধ সেবিকা হয়ে উঠতে চাই বৃহত্তম মহিলা স্বার্থের উন্নয়নে সে আমার প্রথম ইচ্ছে । মা সারদা কে নিয়ে তাবড় তাবড় কলম চলছে অবিরত কিন্তু মাতাজী আমাকে বলেছিলেন শ্রীমার কথাগুলো সহজ সরলভাবে তুলে ধরতে কোন মাধ্যমে , তা হতে পারে youtube চ্যানেল ও । তাই সেদিকে ও কাজ করার ইচ্ছা আছে।

সপ্তমিতা:-আপনাকে সবাই এই দিকে কাজ করতে বলছে তার পেছনে কোন যুক্তি বা বিশেষত্ব রয়েছে কি?

মহুয়া :-আমি চেষ্টা করি খুব সহজ ভাবে  মাকে চিনতে  ও উপস্থাপন করতে। আমাকে সবাই এই কারণে হয়তো অনুরোধ করেন।

সপ্তমিতা ::- সদ্য দেহ রক্ষা করেছেন ও প্রব্রাজিকা অমল প্রানা মাতাজি , উনার বিষয়ে কিছু বলবেন?
মহুয়া:- আমার সৌভাগ্য আমি মাতাজির অনেক আশীর্বাদ পেয়েছি , যা সবসময় আমার পাথেয় হয়ে আগামী পথ দেখাবে । উনার রাতুল চরণে আমার প্রনাম।

সপ্তমিতা :: একজন লড়াকু মহিলার কাছ থেকে সমাজের জন্য কোন বার্তা।

মহুয়া ::-দুঃখ সবার জীবনে আছে শুধুমাত্র মানুষ বেধে বিভিন্ন রূপ নেয়। আমাকে বলতে বলেছেন তাই বলবো দুঃখকে সঙ্গী না করে জীবনে একটু শক্ত হাতে ভালো মুহূর্তকে সঙ্গী করা দরকার। আমি একজন অতি সাধারণ থেকেও যদি সাধারণ গুণ নিয়ে এগিয়েছে তাহলে অন্যরাও পারবে শুধু হাল না ছেড়ে লেগে থাকতে লাগবে।

সপ্তমিতা:- যতদূর জানি আপনার কোন সন্তান নেই ।  তাও অনেক লড়াই করেছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে মহিলাদের জন্য কোন বার্তা  দিতে চাইবেন ?

মহুয়া:- শুধু আমি নয় বা  মা সারদা ও একা লড়াই করে গেছেন ।মহিলাদের বলব ভেঙে না পড়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে এগোতে থাকলে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাত্রি ও ভোরের আলো দেখে।

আপনার মত লড়াকু মহিলা আমাদের সমাজের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আশা করি আপনার যে মূল্যবান সময় আমাদের দিয়েছেন তাতে অনেক সাধারণ মহিলার আত্ম শক্তিবোধ জাগ্রত হবে। আপনার হারানো পরিজনদের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা সমবেদনা ও আপনার প্রতি । স্বামীজি  ও মা সারাদা র আশীর্বাদে অনির্বাপিত হোক  আপনার স্পিহা এবং মশাল হয়ে জ্বালাক হাজার মহিলার জীবনদ্বীপ, প্রজ্জ্বলিত হোক এই শুভেচ্ছা ও প্রার্থনা রইল আমারও যুব দর্পণের তরফ থেকে।

সপ্তমিতা নাথ

Related articles

E Paper 2 Sep 2024

E Paper 26 Aug 2024

spot_img

E Paper 19 Aug

E Paper 12 Aug

Recent articles

E Paper 2 Sep 2024

E Paper 26 Aug 2024

E Paper 19 Aug

spot_img

E Paper 12 Aug